আমার কাঠগড়ায় আমি (৬ষ্ঠ পর্ব)

আজাদুল ইসলাম আজাদ : শুরুতেই নিজেকে একজন রাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গড়ে ওঠার পিছনে কয়েকটি ঘটনার প্রভাবের কথা লিখেছি। বর্ষার বৃষ্টিতে একটি খেঁটে খাওয়া পরিবারের একদিনের ঘটনার কথাও লিখেছি, এরকম ঘটনা কিন্তু একটা নয়। সেদিন যেমন আমার মা ওদের জন্য খিচুড়ি দিয়ে একটা উপদেশ বা নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, ক্ষুধার্থ মানুষকে দেখলে ওনাকে জানাতে বা নিজের খাবার বাঁচিয়ে তাকে কিছু দিলে আল্লাহ খুব খুশি হন, ঠিক তেমনই পরিবারের আরেকজন, যার পরিচয় এখানে না লিখলে আমার ঐ পথে আসার মূল ঘটনাটাই অস্পষ্ট হয়ে রবে, তার প্রতিও অসন্মান হবে।আজই প্রথম এভাবে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে লিখে সকলকেই জানিয়ে দিলাম।

সে ছিল আমার মেজ চাচার পঞ্চম পুত্র, আমার অল্প বড়ো, কিন্তু বাড়ির অন্যান্য সব ভাই বোনের মধ্যে আমার সবচেয়ে আপনজন, চাচাতো ভাই জাফিরুল ইসলাম (জাফু ভাই)। স্বাধীনতার পর পরই ঢাকা চলে আসে,এবং এখানে একমি ফার্মাসিউটিক্যালসের কেমিস্ট, পরবর্তীতে সেখানেই আরও উচ্চপদে চাকরি করে অবসরে খুবই আনন্দঘন সংসার করতে করতে মাত্র কয়েক মাস আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিকভাবে মৃত্যু বরন করে। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, আল্লাহ যেন তাকে বেহেশতবাসী করেন।
আমরা দু’ভাই একই বিছানায় শোয়া,গল্প করা,দু’জন মিলে বাড়ীর কৌটার পাউডার দুধ চুরি করে খাওয়া, কোন ঘরে নারকেলের নাড়ু বানিয়ে কোন শিকায় রাখা আছে, সেটা চুরি করে খাওয়া, এরকম অসংখ্য ঘটনা। তাই মানুষের এই কষ্টের কথাটাও একদিন তার কাছে বলে ফেললাম, আমি কি করেছি সেদিন, তাও বললাম। তখন সেও বললো, বুদ্ধিও দিল, একাজ টি সেও করে, কিভাবে করে,তাও জানালো। সে বললো, কারও এরকম সংকটে সে তাদের ঘরে একটা তামার বড়ো বদনায় চাল নিয়ে বাড়ির বাইরে পিছনে পুরুষদের যে পায়খানা ছিল, সেখানে যাবার অভিনয় করে সবার সামনে দিয়েই নিয়ে যায়, বাড়ির মানুষের আড়ালে ওদের দিয়ে চলে আসে, কেও বুঝতে পারে না। এবার এখানেও আমাদের সখ্যতা বাড়লো, এবং বলা যায়,আমরা দু’ভাই কেউ সেরকম এলে তাদেরকে ফিরাতাম না। কেউ কেউ এসে আমাদের বাগানের বড়ো কাঁঠাল চেতো, ওটা সিদ্ধ করে সকলের সারাদিনের খাবার হবে, নিজেই ভরদুপুরে বাগানে গিয়ে নিজেই কাঁঠাল পেড়ে দিয়ে কৃতার্থ হয়েছি। সেই ভাইটিই হঠাৎ একদিন বললো, চল একেবারে গোপনে কাউকে না বলে রায়টা ট্রেনে চুয়াডাঙ্গায় যাই। কেন জিজ্ঞেস করতেই বললো, শেখ মুজিব আসবে,মিটিং শুনে আসি। সম্ভবত ১৯৬৬ সাল, বাড়ীতে তখনও হাফপ্যান্ট পরি।

দু-তিন দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে। দুজনের মধ্যে ইশারায় কথা হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আব্বা ঘর থেকে বের হওয়ার মূল দরজার সামনে চেয়ার নিয়ে বসে বৃষ্টি উপভোগ করছেন। আমি কাপড়ও পালটাতে পারছি না, বেরোতেও পারছি না । দু’ভাই আরেক ইশারায় ওদের ঘর থেকে তাকে বেরিয়ে আমাদের ঘরের পিছনে আসতে বললাম। আমি আব্বার আড়ালে আলনা থেকে পরে যাবার কাপড় নিয়ে ঘরের পিছনের বৈঠকখানার এদিকের দরজা শিকল খুলে দিতে বলতেই সে খুলে দিল, আমি ঘরের পিছনের জানালা দিয়ে ছুড়ে দিয়ে বৈঠকখানার ভিতরে ফেলতেই ও তুলে চৌকির উপর রাখলো, আমি শান্ত চেহারায় আব্বার সামনে দিয়েই রোয়াক থেকে বদনা নিয়ে গামছা মাথায় বাইরের পায়খানায় যাওয়ার ঢং-এ বাড়ির বাইরে এসে কাপড় পালটিয়ে, পরনের সব ওখানেই রেখে বাড়ির পিছন দিয়ে দর্শনা রেলস্টেশনের পথে হাটলাম কাঁদা মাড়িয়ে। সেদিনও তিন রকমের উত্তেজনায় অস্হির। এক হলো,আব্বা সহ সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরুনোর, দ্বিতীয়তঃ শেখ মুজিব কে দেখবো ও বক্তৃতা শুনবো,তাও আবার পালিয়ে চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে।

তৃতীয়ত তখন সন্ধ্যার পর যে ট্রেনটা দর্শনা আসতো,সেটা এসে পৌঁছাতে সাড়ে সাতটা বাজতো, বাড়িতে ফিরে কি জবাব দেব। এসব মাথায় নিয়েই খুব জোরে হেটে কাদা ভেঙে ষ্টেশন পৌঁছাতেই ৫/৭ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন ছাড়লো। তখন ভয়,টিকিট ছাড়া যাচ্ছি, টিটি র দিকে খেয়াল রাখা। যে বগীতে উঠেছি দেখেশুনেই উঠেছি।তখনও এক বগী হতে অন্য বগীতে যাওয়ার এখনকার মতো ব্যাবস্হা চলন্ত ট্রেনে ছিল না। সুতরাং মাঝখানে জয়রামপুর ষ্টেশনে নেমে সাধু সেঁজে প্লাটফর্মে এমনভাবে দু’জন কথা বলে টিটি কে খেয়ালে রাখতে হবে যে উনি যেটাতেই উঠবেন, আমরা সেটাতে তো নয়ই, পাশের টাতেও নয়।সেই মতো জয়রামপুর আসামাত্রই নেমে সাধু বেশে ট্রেন দেখছি, আর টিটি কে খেয়ালে রাখছি, গল্পের ছলে পরিকল্পনা করছি দুজন। কেউ যেন না বোঝে আমরা গাড়ির প্যাসেন্জার। পরিকল্পনা মতোই আমরা অন্য বগীতে উঠে পড়ে তৃপ্ত হলাম। কিন্তু নতুন উত্তেজনা, চুয়াডাঙ্গা ষ্টেশন থেকে বের হওয়া।

ঠিক হলো গাড়ি থেকে নেমেই সোজা ওভারব্রীজে উঠে দেখতে থাকবো। সব প্যাসেন্জার টিটি সহ ফাঁকা হলে ওভার ব্রীজ থেকে নামতে হবে। তা-ই করে সহজেই বেরিয়ে আসতে পারলাম, এরপর দ্রুত হাটা, কোথায় সভা। তখন আর বৃষ্টি নেই। পোঁছালাম নারকেল বাগানে, পৌরসভার সামনে। মাত্র কয়েকশত মানুষ। কিছু পরেই শেখ মুজিব বক্তৃতা শুরু করতে উঠলেন। উনি তখনও বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি। হাল্কাপাতলা গড়নের লম্বা, খদ্দর কাপড়ের পাঞ্জাবি,পাজামা পরে উনি যা বলা শুরু করলেন, তা দেখি গ্রামের লোকের নিত্য জীবন কাহিনী। এক পর্যায়ে এক ছাগলের তিন বাচ্চার গল্প শুনিয়ে তিন নং (নাবি, বা অন্য দুই বাচ্চার পরে মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসা,আগের দুটোর তুলনায় স্বাস্থ্য খারাপ এবং দূর্বল) বাচ্চার সাথে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে তিরস্কার করে বক্তৃতা করলেন, এবং আমাদের এই বাংলায় ঐ পশ্চিমা শাসকদের এবং তাদের এদেশীয় এজেন্টদের সৃষ্ট বৈষম্যের নানা বর্ননা দিয়ে আমাদের বাঙালী জাতিকে বঞ্চিত রাখার দুঃশাসনকে বুঝালেন। ঐ কচি মনে দ্রুত দ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো আমার। উনি বাঙালির ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং ঐ পশ্চিমা শোষণ, বন্চনা, আমাদের এই তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মানুষের কল্যানের আহ্বান জানিয়ে সরকার পরিচালনা করতে আহ্বান করলেন।

ওখান থেকে সভা শেষে ফিরে এসে বাড়িতে অনুমিত বকাবকি নীরবে হজম করলাম। কিন্তু ঐ সভা থেকে একটি অন্য অুনুভূতি নিয়ে ফিরলাম, তা হলো, আমি এবং আমরা বাঙালী, পাকিস্তানি নই। মনে হতে লাগলো, এখান মুক্ত হওয়ার পথে হাটা যদি রাজনীতি হয়,তবে তো রাজনীতিই করা বা বুঝা, বাঙালির প্রধান দায়িত্ব। শুরু হলো দর্শনার রাজনৈতিক সভা শোনার এক আকর্ষণীয় অভিসার। একদিকে ফুটবল, পাশাপাশি রাজনৈতিক সভা, আলোচনা, সংস্পর্শ,, সবই যেন আকর্ষণ করতে লাগলো আমাকে।নিজের ভিতরের অনুভূতি পরিবর্তিত হতে থাকলো। গ্রামে বসবাসের কারণে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত যে বৈষম্য আর বঞ্চনার বাস্তবতা অধিকাংশ মানুষের জীবনে দেখার সূযোগ হয়েছিল, তাতেই প্রকাশ করতে সংকোচে থাকলেও অনুভূতির যন্ত্রণা আমাকে তাড়িয়ে ফিরতে লাগলো। এর মধ্যেই অল্পদিনের মধ্যেই চিনলাম, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এ্যাডঃশহীদুল ইসলাম, সৈয়দ মজনুর রহমান কে। দর্শনায় তখন ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া আর কোন ছাত্র সংগঠন ছিল না সেভাবে। ফলে রাজনীতি বুঝতে ওনাদের ছোটো ছোট বৈঠকেও শুনলেই যেতাম, বুঝার চেষ্টা করতাম। যেটাই শুনতাম,সেটা নিজের মধ্যে চর্চায় নিয়ে ভাবতাম।এভাবেই রাজনৈতিক জীবনের শুরু, রাজনীতির পথচলা শুরু। যেখানে শিখলাম, বৈষম্য, শোষন,নির্যাতন, নিপিড়ন,,, ,,, এসব থেকে মুক্তির আশায় পথচলা, শ্রেনী বিন্যাস, শোষিত শ্রেনী, শোষক শ্রেণী, ব্যাক্তিমালিকানা, সবই মোটামুটি একটা ধারনায় নিলাম।

এই পথে চলতে চলতেই পথের মতের পরিবর্তন হয়েছে, কারন চুয়াডাঙ্গার সেই জনসভার শেখ মুজিবের বক্তব্য, যেখান থেকে আগেই বাঙালী হয়ে ফিরেছি, যেখানেই থাকি, যেখানেই যাই না কেন, ঐ
বাঙালী স্বত্ত্বা তখন প্রতিনিয়তই পীড়িত করতে থাকে।
এ যেন মাটির গুন, এ যেন মাতৃগর্ভের সৃষ্টি, যেন এই বাংলার প্রকৃতির দান। এভাবেই তখন আমার ভিতরে আলোড়িত হতো সেই শেখ মুজিবের আহ্বান। আজ এ পর্যন্তই। যাঁরাই মূল্যবান সময় ব্যায় করে পড়ে কমেন্ট করছেন, উৎসাহিত করছেন, তাদের সকলের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।দোওয়া করবেন, যেন শেষ করে যেতে পারি।