ঈদুল ফিতর প্রতিবছর ধরণীতে এক অনন্য-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে

সাইফুল ইসলামঃ সারা বিশ্বের মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর অনাবিল আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। ‘ঈদ’ মুসলিম উম্মাহর জাতীয় উৎসব। ঈদুল ফিতরের দিন প্রতিটি মুসলমান নারী-পুরুষের জীবনে অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। ঈদুল ফিতর প্রতিবছর ধরণিতে এক অনন্য-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানের সিয়াম সাধনার শেষে শাওয়ালের এক ফালি উদিত চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদের আগমনী বার্তা। সিয়াম পালনের দ্বারা রোজাদার যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, ইসলামের যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দানশীলতা, উদারতা, ক্ষমা, মহানুভবতা, সাম্যবাদিতা ও মনুষ্যত্বের গুণাবলি দ্বারা বিকশিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুন্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর সমাগত হয়। এ দিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্যময়তা দ্বারা পরিপূর্ণ। শাওয়ালের চাঁদটি দেখামাত্র বেতার-টেলিভিশন ও পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় ঈদের আগমনী বার্তা।

সুদীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ প্রতিটি মুসলমানের ঘরে নিয়ে আসে আনন্দের সওগাত। ঈদগাহে কোলাকুলি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করে। মাহে রমজানের রোজার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদের খুশি। ঈদুল ফিতর বা রোজা ভাঙার আনন্দ-উৎসব এমনই এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত করে, যা মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথপরিক্রমায় চলতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সানন্দে ঘোষণা করেন, ‘প্রতিটি জাতিরই আনন্দ-উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এই ঈদ।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ঈদ ধনী-গরিব সব মানুষের মহামিলনের বার্তা বহন করে। এক কাতারে দাঁড়িয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের একসঙ্গে নামাজ পড়ার সুযোগ এনে দেয় ঈদ। ঈদের খুশির এক অন্যতম উপকরণ হচ্ছে ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে রোজা রাখার পর ঈদের নামাজ আদায়ের পর ঈদগাহ ময়দানে একে অপরের হাতে হাত, বুকে বুক রেখে আলিঙ্গন করলে মুসলমানরা সারা মাসের রোজার কারণে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট ভুুলে যায়। সমাজের সর্বস্তরের মুসলিম জনতা ঈদের নামাজের বার্ষিক জামাতে সানন্দে উপস্থিত হয়। এ যেন একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের এক অপূর্ব সুযোগ। তখন ছোট-বড়, ধনী-গরিব, আমির-ফকির, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে কোনো রকম ভেদাভেদ বা বৈষম্য থাকে না।

ঈদের নামাজের অশেষ ফজিলত ও সম্মানজনক মর্যাদা সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘ঈদুল ফিতরের দিন ফেরেশতারা রাস্তার মুখে মুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন: হে মুসলিম! নেককাজের ক্ষমতাদাতা ও সওয়াবের আধিক্যদাতা আল্লাহর কাছে অতি শিগগির চলো। তোমাদের রাতে ইবাদত করার হুকুম করা হয়েছিল, তোমরা তা করেছ, দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তোমরা তা পালন করেছ। তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তাকে খাইয়েছ (অর্থাৎ গরিব-দুঃখীদের আহার দিয়েছ) আজ তার পুরস্কার গ্রহণ করো। অতঃপর মুসলমানরা যখন ঈদের নামাজ পড়ে তখন একজন ফেরেশতা উচ্চ স্বরে ঘোষণা করেন, তোমাদেরকে তোমাদের সৃষ্টিকর্তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখন তোমরা তোমাদের পুণ্যময় দেহ-মন নিয়ে নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন কর। এ দিনটি পুরস্কারের দিন, আকাশে এই দিবসের নাম “উপহার দিবস” নামে নামকরণ করা হয়েছে।’ (তাবারানি)

ঈদ মানেই পরম আনন্দ ও খুশির উৎসব। ‘ঈদ’ শব্দটি আরবি, শব্দ মূল ‘আউদ’, এর অর্থ এমন উৎসব যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়, রীতি হিসেবে গণ্য হয় প্রভূতি। এর অন্য অর্থ খুশি-আনন্দ। উচ্ছল-উচ্ছ্বাসে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত। ঈদুল ফিতর প্রতিবছর চান্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী শাওয়াল মাসের ১ তারিখে নির্দিষ্ট রীতিতে এক অনন্য আনন্দ-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে। এক মাস কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নানা নিয়মকানুন পালনের পর মুসলিম বিশ্বে উদ্যাপিত হয় ঈদুল ফিতর; অন্য কথায় রোজার ঈদ। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া। আরেক অর্থে বিজয়। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর যে উৎসব পালন করা হয়, তা-ই ঈদুল ফিতরের উৎসব। বিজয় শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। রমজান মাস রোজা রেখে আল্লাহ-ভীরু মানুষ তার ভেতরের সব ধরনের বদভ্যাস ও খেয়াল-খুশিকে দমন করার মাধ্যমে একরকমের বিজয় অর্জন করে। সব মিলিয়ে ঈদুল ফিতরকে বিজয় উৎসব বলা যেতে পারে।

ঈদুল ফিতরের প্রতিটি অনুশাসনে ইবাদতের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, তা ছাড়া এ দিন প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনের তাগিদ এবং মানবতার বিজয় বার্তা। তবে প্রচলিত নিয়মে দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে দিনটিকে স্মরণীয় করার নাম ঈদ উৎসব। ‘ঈদুল ফিতর’ শব্দ দুটিও আরবি। যার অর্থ হচ্ছে—উৎসব, আনন্দ, খুশি ও রোজা ভঙ্গকরণ প্রভূতি। সুদীর্ঘ একটি মাস কঠোর সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ ধরণিতে যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন, সেটিই ঈদুল ফিতর।

পূর্ণ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে উম্মতে মুসলিমার জন্য খুশির দিন হিসেবে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র ঈদুল ফিতর দান করেছেন। ঈদ শব্দের অর্থ বারবার ফিরে আসা। ঈদকে ঈদ এ কারণেই বলা হয় যে, প্রতি বৎসর শাওয়াল মাসে ঈদ বারবার ফিরে আসে। শরিয়তের পরিভাষায় ঈদকে আনন্দ, খুশি বা উৎসব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই দিনে বান্দাহর প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হয়। এইদিন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান দেওয়া হয়। প্রতি বৎসর খুশির বার্তা নিয়ে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরের দিন ঈদুল ফিতর এর দুই রাকাত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে ঈদ শুরু হয়।

হাদিস শরিফে এসেছে, ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করে ফেরার পথে ফেরেশতা রাস্তায় মোড় মোড় দাঁড়িয়ে রোজা পালনকারীকে এই বলে স্বাগতম জানাতে থাকে যে, হে মহান আল্লাহপাকের বান্দাহগণ! আপনাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো, আপনাদের পাপ মোচন করা হলো। ঈদের রাতের ফজিলত হজরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে ইখলাসের সঙ্গে সওয়াব ও প্রতিদানের আশায় আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে লিপ্ত থাকিবে, কিয়ামতের কঠিন ও ভয়ানক দিনে তার অন্তর সজীব থাকিবে, অর্থাৎ সে শান্তি ও নিরাপত্তায় থাকিবে। ঈদের রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকা, দুরুদ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব।

প্রকৃতপক্ষে ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখী-অসুখী, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের আয়োজন। ঈদ ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে ধনী-গরিব সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয় এবং পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়। আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, জগতের সব মানুষের সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। আগামী দিনগুলো সত্য, সুন্দর ও সৌন্দর্যম-িত হোক! হাসি-খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক! ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা।

প্রত্যেক জাতিরই নির্দিষ্ট উৎসব রয়েছে। সে উৎসবের মাধ্যমে সে জাতি তাদের সামর্থ্যানুযায়ী সুন্দর পোশাক পরিধান, উৎকৃষ্ট খাদ্যদ্রব্যসহ আরও বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের খুশি অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। ইসলাম ধর্মেও দুটি উৎসব রয়েছে একটি ঈদুল ফিতর আরেকটি ঈদুল আজহা। এই দুটি উৎসবই মুসলিম মিল্লাতের ধর্মীয় প্রধান উৎসব। ঈদুল ফিতর শুধু উৎসবই নয় বরং একটি ইবাদত। হাদিস শরিফে আছে, হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, রাসূল (স.) ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হতেন। অতঃপর নামাজ পড়ে ঈদের আনন্দ শুরু করতেন (মুসলিম শরিফ)। সুতরাং এই হাদিসে দেখা যাচ্ছেÑ প্রথমে নামাজ তারপর আনন্দ। প্রথমে ইবাদত তারপর উৎসব। প্রথমে আল্রাহ তায়ালার শুকুর আদায় তারপর শরিয়তের ভেতরে থেকে আনন্দ প্রকাশ।

পবিত্র ঈদুল ফিতরে ধনী-গরিবের মাঝে থাকে না কোনো বৈষম্য। ঈদের আনন্দে একাকার হয়ে যায় সকলে। কোলাকুলি করে শত্রুকে করে নেয় আপন। সকলের মাঝে জাগ্রত হয় জান্নাতি পরিবেশ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরিপূর্ণ সওয়াব, বরকত দান করুন এবং আমরা যেন মাহে রমজান ও পবিত্র ঈদুল ফিতরের শিক্ষাকে নিজেদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে সত্যিকারের মানুষ হতে পারি আল্লাহ তায়ালা আমাদের সে তৌফিক দান করুন। তাই আসুন, ঈদের নির্মল আনন্দ ছড়িয়ে দিই সবার মনে-প্রাণে; বুকে বুক মিলিয়ে চলুন সবাই সবার হয়ে বলে যাই, ‘ঈদ মোবারক।’

মডেলঃ রোমানা আমিন
ড্রেস ও গহনাঃ Bend da trend
সাজঃ কাজী রানা
ছবিঃ রাইহানুর তানজিদ