উন্নয়ন ও ধর্ষণ

হাবিবুর রহমান রিজু

একজন এমপি অহংকার মিশ্রিত চ্যালেঞ্জের সুরে আমাকে বলেছিলেন , ‘আমি জনগণের টাকা খাইনে , আমি সরকারি টাকা খাই ’। আমার মাথা কাজ করেনি, সরকারের ধন-সম্পত্তি যে জনগণের নিজের না, এটা বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশের মানুষ মনে করে কিনা তা গবেষণা করে বের করতে হবে। আর সরকারের ধন-সম্পত্তি নিজের মনে করে না বলে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, আমলা-কর্মচারি ও ক্ষমতাবান সকল মহোল সরকারি ধন-সম্পত্তি আহরণের মহারণে মহামত্ত । সরকারি গাড়ি-বাড়ি, চাকর-বাকর ও বেতন জনগণ দেয়, এটা মনে করা এমপি অথবা মন্ত্রী, কর্মচারি-কর্মকর্তা একজনও আছেন কিনা সন্দেহ আছে বরং এই অর্জন তাদের যোগ্যতার ন্যায্য অধিকার, যেমন তাদের বাপ-দাদার ধন-সম্পত্তির উপর জন্মগত অধিকার। তাই সরকারি অফিসে কাজ করতে গেলে, জনগণকে টাকা দিয়ে কাজ করাতে হয়।
যত উন্নয়ন ততো টাকা। উন্নয়ন প্রকল্পের টাকার অংশ ভাগ হয় রাজনীতিক, আমলা, কর্মচারি ও চামচাদের মধ্যে। অবশিষ্ট অংশ সংশিল্ট ঠিকাদার।

একজন ঠিকাদার আমাকে বলেছিলেন, দেড় কোটি টাকার কাজে এমপিকে দিয়েছেন ষাট লাখ, চামচা গ্রুপকে আট লাখ , অফিসকেও দিতে হবে। অবিশ্বাসে আমার চোখ কপালে চলে গেল । বললাম , তাহলে লোকসানে কাজ করছেন কেন ? ঠিকাদার মুচকি হেসে বললো, সওজ-এর কাজ সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই, কাজ এক্সটেনশন হবে তিরিশি লাখ এই তিরিশ লাখ টাকা লাভ । আমি বোকা বনে গেলাম। ( নিম্ন মানের কাজ হচ্ছে বলে, এই কাজে ক্ষমতাশীন ছাত্র সংগঠনের জেলা সাধারণ সম্পাদক বাঁধার সৃষ্টি করলে এমপি সাহেব তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন )। দ্রুত ধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ পৃথিবীতে শীর্ষে অবস্থান করছে। দ্রুত ধনী হওয়ার অনৈতিক প্রতিযোগীতার সাথে হাত ধরাধরি করে ভোগের আকাংখা তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করেছে । ক্ষমতাবানদের এই অসুস্থ্য ভোগ প্রক্রিয়া সমাজে অভিঘাত সৃষ্টি করছে । যারা দুর্বল ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাবানদের হাতিয়ার, অথবা বিচ্ছিন্ন কেউদের মধ্যে বিকৃত ভোগ আকাংখার জন্ম দিচ্ছ, বাড়ছে বিভিন্ন পন্থার ধর্ষণ।

বাংলার মহামনিষী রবীন্দ্রনাথসহ পৃথিবীর অসংখ্য মনিষী বাণী দিয়েছেন যে, নৈতিক উন্নয়ন ছাড়া কোন উন্নয়নই প্রকৃত উন্নয়ন নয়। ঝিনাইদহ জেলার সাবেক এক জেলা প্রশাসক ( পরবর্তীতে বড় আমলা হয়েছিলেন ) ঝিনাদার একজনকে ভালবাসতেন। ভদ্রলোক বহুদিন পর এলজিইডির প্রশাসক কাম হিসাব পরিচালক সাথে করে ঝিনদোতে এসে দেখেন তার আদরের লোকটির অর্থমন্দা যাচ্ছে । তিনি বললেন , দেখো কোন রাস্তার অবস্থা খারাপ, বরাদ্দ দেওয়া হবে তুমি কাজটি করবে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার অল্প সুযোগ হয়েছিল তাৎক্ষণিক বিষয়টি জানার। আমি প্রস্তাব করলাম , ঝিনেদা থেকে নারিকেলবাড়িয়া যাওয়ার রাস্তার অবস্তা খুবই বেহাল। টিম সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। আমি বেশ কিছুদিন পরে কৌতুহল বশতঃ খোঁজ নিতে গেলাম লাভ প্রত্যাশি ব্যক্তির কাছে। টানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, নারে , হলো না , ঢাকাতে স্যাররা যেয়ে দেখে তিনমাস আগে এই রাস্তার কাজ হয়ে গেছে, বিলও তুলে নিয়েছে । আমি বললাম, রাস্তাতো হয়নি। উনি বললেন , স্যাররা বলেছেন মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে একই রাস্তায় বরাদ্দ দেওয়া যায় না । ঝিনাইদহ-র মত জায়গায় এটা খুবই ছোট্ট উদাহরণ, বড় বড় অর্থক্ষেত্রে যে কি হয় সহজে অনুমেয়।

আইন আইন কঠোর আইন, শাস্তি নিয়ে বিস্তর উচ্চকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু আইনের অপব্যবহার নিয়ে ধর্মঘট নেই । যত কঠোর আইন ততো দুর্নীতি। র‌্যামিটেন্স, শক্তিশালি কৃষি অর্থনীতি, শ্রমজীবি মানুষের শ্রমের বিনিময়ে যে প্রবৃদ্ধি এবং দেশের সম্পদ-সম্পত্তি তা মুষ্টিমেয় মানুষ গ্রাস করছে যা আজকের দৈনিক কাগজেও একজন বিশ্লেষক বলেছেন। নৈতিক অধঃপতন করোনা মহামারির থেকেও ভয়াবহ মহামারি আকারে উপর তলা থেকে তৃনমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। নৈতিক বোধহীন ভোগ-বিলাসে মত্ত নির্ভয় লুটেরা সমাজ ধর্ষণ প্রবণতার জন্মদাতা। দুর্দমনীয় দুর্বৃত্তায়নের অনিবার্য অনুসঙ্গ ধর্ষণ মহামারি। অবিলম্বে অবৈধ ধন-সম্পদ অর্জনকারিদের ধন সম্পদ বাজায়েপ্ত করে কারাদন্ডের দাবিতে শাহবাগে অনশন শুরু হলে এবং বাস্তবায়ন হলে আশিভাগ ধর্ষণ সয়ংক্রিয় ভাবে উধাও হয়ে যাবে। যে দেশে আইনের শাসন নেই, সে দেশে নতুন নতুন আইন দুর্বৃত্তায়নের সহায়ক ছাড়া আর কি হতে পারে ? দুর্দমনীয় দুর্বৃত্তদের হাতে আইন তুলে দেওয়া মানে ডাকাতের হাতে শক্তিশালি অস্ত্র তুলে দেওয়ার থেকেও ভয়ংকর।
প্রতিপক্ষ দমন করার জন্য আইনের অপব্যবহার-এর সব চেয়ে বড় উদাহরন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি নুর ও তার সহচররা। কেউ কি শুনেছেন, আইনের অপব্যবহারের জন্য কারো আজ পর্যন্ত শাস্তি হয়েছে ? এটা কি মানবতা বিরোধী অপরাধ নয় ? সর্ব গ্রাসি দুর্বৃত্ত মনন-ই ধর্ষণ মহামারি প্রধান উৎস। উন্নয়নের নামে দুর্বৃত্তায়নের উন্নয়ন হবে , ধর্ষন নতুন নতুন রুপে সংঘটিত হবে। আর উন্নয়ন নিয়ে দুর্বৃত্ত সহযোগীরা বড় গলায় কথা বলেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, নবাব সিরাজ -উদ-দৌলার বংশধরা যদি আজ পর্যন্ত রাজত্ব করতো তবুও বাংলাদেশ ডিজিটালাইজড হতো, সভ্যতার ধাঁক্কায় আফ্রিকার বর্বরদের হাতেও এনডরয়েড মোবাইল সেট এমন কি সেটেলাইট হ্যাান্ডসেট পৌঁছে গেছে।

চেতনার সূতিকাগার ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের ভিপিকে প্রহার করা যায় তা সামাজিক ও রাষ্ট্রীক বোধে অতীতে কল্পনাও করা যেত না,পাকিস্তান আমলেও না। ভিপি নূরকে সাতবার প্রহার করা হয়েছে । সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন চার হাজার কোটি টাকা সামান্য টাকা, তখন অনেকে বেকুব বনে যায়। বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী ঠিক তথ্যটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যে পরিমাণ টাকা দুর্নীতি হয় সেই তুলনায় চার হাজার কোটি টাকা সামান্য বটেই। এ এক অন্য বাংলাদেশ।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, কলাম লেখক