চঞ্চল-শাওনের কণ্ঠে যুবতী রাধে : আইন বলছে অবৈধ

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘আইপিডিসি আমাদের গান’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী পার্থ বড়ুয়ার সংগীতায়োজনে ‘যুবতী রাধে’ গানটি প্রকাশ হয়েছে ইউটিউবসহ সোশাল মিডিয়ায়। এটি গেয়েছেন জনপ্রিয় দুই তারকা চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওন। তাদের কণ্ঠে গানটি বেশ সাড়া ফেলেছে।

এ গান নিয়ে বেধেছে বিতর্ক। গানটি মূলত সরলপুর ব্যান্ডের। কিন্তু আইপিডিসি গানের পরিচয়ে তাদের কোনো কৃতজ্ঞতা দেয়নি। সেখানেই বিপত্তি। তাই সরলপুর ব্যান্ড গানটি সরিয়ে নিতে আইপিডিসিকে অনুরোধ জানিয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে নিজেদের ইউটিউব চ্যানেল থেকে গান সরিয়েও নিয়েছে আইপিডিসি।

তবে গানটি এখনো প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে রয়েছে দাবি করে সেটিও সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ করেছে সরলপুর ব্যান্ড। অন্যথায় তারা আইনের আশ্রয় নেবেন বলে হুমকিও দিয়েছেন।

এদিকে ‘যুবতী রাধে’ গানটি নতুন করে দারুণ সাড়া পাওয়ার পর সরলপুর ব্যান্ডের আপত্তি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। কেউ সরলপুর ব্যান্ডের পক্ষে বলছেন তো কেউ আইপিডিসি, পার্থ বড়ুয়া, চঞ্চল ও শাওনের প্রশংসা করছেন এই গানটিকে চমৎকারভাবে নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য। তারা ‘যুবতী রাধে’ গানটিকে প্রচলিত গান দাবি করে উল্টা সরলপুর ব্যান্ডের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন।

বহুল প্রচলিত গানের খানিকটা এদিক সেদিক পরিবর্তন করে সেটা কেউ নিজের গান বলে দাবি করতে পারে কি না সেই প্রশ্ন তাদের। সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেষ্টা করেছে জাগো নিউজ।
এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখে সেটা জানালেন কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা বিচার বিশ্লেষণ করেই দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সরলপুর ব্যান্ডকে ‘যুবতী রাধে’ গানটির রেজিস্ট্রেশন দিয়েছি। কপিরাইট বিষয়টি জটিল, তবে এটি বুঝতে পারলে খুব সহজ। যারা কপিরাইট সম্পর্কিত সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের উচিত এই আইন সম্পর্কে জানা ও বোঝা।

যারা রিমেক করেন বা অন্যের গান কভার করেন তারা একটু কষ্ট করে কপিরাইট অফিসে যোগাযোগ করলেই কিন্তু গানের মালিকানা বা কি পরিচয় সেগুলো জানতে পারেন। তখন আর এসব বিতর্ক তৈরি হয় না।’

চঞ্চল ও শাওন যে গানটি সম্প্রতি গেয়েছেন সেটি সরলপুর ব্যান্ডের নামে রেজিস্ট্রেশন করা দাবি করে এই কপিরাইট কর্মকর্তা বলেন, ‘সরলপুর ব্যান্ড ‘যুবতী রাধে’ গানটি নিজেদের রচিত, সুর করা ও তৈরি হিসেবে ২০১৮ সালের ৪ জুন মাসে তারা কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন নিয়ে নেয়। তার ৭-৮ মাস পর ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল সুমি মির্জা নামে একজন শিল্পী আপত্তি তুলেন যে এই গানটি মৈমনসিংহ গীতিকার ‘যুবতী রাধে’ গানের নকল। যেহেতু একটি অভিযোগ আসে তাই তখন আমরা বেশ কয়েকটি শোনানি করেছি এই গানের জন্য। তখন সরলপুর ব্যান্ড আমাদের ২০১২ সালের একটি রেফারেন্স দেয় যেখানে দেখা যায় চ্যানেল নাইনে একটি অনুষ্ঠানে তারা গানটি গাওয়ার সময় বলছে যে এই গানের ৩০ পারসেন্ট তাদের সংগ্রহ আর ৭০ পারসেন্ট তাদের রিমেক করা।

আমরাও বিশ্লেষণ করে দেখলাম যে মৈমনসিংহ গীতিকার ‘যুবতী রাধে’ গানটিতে মোট ৪২টি বাক্য বা লাইন রয়েছে। ওই গানের শেষের তিনটি লাইনের ভাবের সঙ্গে সরলপুর ব্যান্ডের গানটির মিল আছে। কিন্তু হুবহু বাক্যের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। যার ফলে এটি যে মৈমনসিংহ গীতিকার ওই গান তা সঠিক নয়। এ কারণে আমরা ‘যুবতী রাধে’ গানটির রেজিস্ট্রেশন সরলপুর ব্যান্ডের নামেই বহাল রেখেছি।

আর সুমি মির্জাকে বলেছি কপিরাইট আইনের ৬০ ধারা অনুসারে তারা যদি গানটি গাইতে চায় তাহলে সরলপুরের অনুমতি নেবে। যদি সরলপুর অনুমতি না দেয় তবে কপিরাইট বোর্ডের কাছে আবেদন করলে আমরা একটা শোনানি দিয়ে দুই পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে একটি নির্দিষ্ট রয়েলটি ফিক্সড করে গানটি যেন সুমি মির্জা গাইতে পারেন তার বৈধ ব্যবস্থার জন্য সরলপুরকে অনুরোধ করবো। যদি সেখানে সবকিছু ইতিবাচক বলে মনে করে সরলপুর ব্যান্ড তাহলে তারা অনুমতি দেবে। তাদের অনুমতি ছাড়া এই গান কিছুতেই সুমি মির্জা বা কেউ গাইতে পারবেন না।’

এ গানের অনেক ভার্সনই ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে যেগুলো নিয়ে এতদিন কোনো আপত্তি তুলেনি সরলপুর ব্যান্ড। কিন্তু সম্প্রতি আইপিডিসির আয়োজনে গানটি প্রকাশ হতেই তারা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেটি সরিয়ে দিয়েছে। আগের ভার্সনগুলোও কি অবৈধ নয় জানতে চাইলে জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘যদি তারা অনুমতি না নিয়ে সেগুলো প্রকাশ করে থাকেন তাহলে অবশ্যই অবৈধ। সেসব গানের ব্যাপারে সম্পূর্ণই সরলপুর ব্যান্ড সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের কিছু বলার নেই। তার গান তিনি যাকে খুশি দিতে পারেন যাকে ইচ্ছে হবে না দেবেন না।’

ভাবধারা অনুসরণের বৈধতা প্রসঙ্গে জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘ভাব অনুসরণ করা তো খুবই কমন একটি ব্যাপার। যে কেউই যে কোনোকিছুর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হতে পারেন। এটাতে আসলে নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। কপিরাইট আইন যেটা দেখতে পারে সেটা হলো কারো সঙ্গে আপনার ভাব বা বাক্যের হুবহু কোনোকিছু মিলে গেল কী না।

ধরা যেতে পারে রবি ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি থেকে কেউ যদি অনুপ্রাণিত হয়ে লেখে ‘আমার মল্লিকপুর আমি তোমায় খুব ভালোবাসি’ তাহলে সেটাকে অবৈধ বলা যাবে না। এখানে কিন্তু হুবহু মিল নেই। ভাব একই থাকতে পারে। কিন্তু প্রকাশভঙ্গী যদি আলাদা হয় তাতে কপিরাইট আইন ভঙ্গ হয় না।’

বেশ কিছু গণমাধ্যমে সরলপুর ব্যান্ড দাবি করেছে ‘যুবতী রাধে’ গানটি তারা ৩০ পারসেন্ট সংগ্রহ করেছে আর বাকিটুকু তাদের নিজস্ব মেধা। এক্ষেত্রে ৩০ পারসেন্টের বিষয়ে আইন কী বলে সেটাও জানালেন জাফর রাজা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সরলপুর ব্যান্ড এই ৩০ পারসেন্টের বিষয়ে কপিরাইট অফিসে একটি লিখিত বক্তব্য দাখিল করেছে। সেখানে তারা দাবি করেছে যে তারা কোনো গানের হুবহু কোনো লাইন বা অংশ সংগ্রহ করেনি। তারা কিছু গানের ভাবধারাকে অনুসরণ করেছে মাত্র। সেকারণেই এই গানটির মালিকানা তারা দাবি করতে পারে। এখানেই দেশে প্রচলিত কপিরাইট আইনে কোনো বাঁধা নেই।’

সরলপুর ব্যান্ডের দাখিল করা বক্তব্যটি হলো, ‘আমরা সাধক-সাধিকার কীত্তন গানগুলোর মধ্য থেকে রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, শব্দ চয়ন ও ভাবধারা সংগ্রহ করে থাকি। এর প্রেক্ষিতে আমরা ৩০ পারসেন্ট সংগ্রহ বলে উল্লেখ করেছি। আমরা ওই সাধক-সাধিকাদেরকে সবসময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকি বলেই অনুষ্ঠানে তাদের কথা এর আগে উল্লেখ করেছি। সাধকের গানের সাথে আমাদের ‘যুবতী রাধে’ গানের কোনো অংশের সাথে কোথাও হুবহু কোনো মিল নেই এবং এই ৩০ পারসেন্টে আমরা কোনো হুবহু লাইন সংগ্রহ করিনি। আমরা শুধুমাত্র ভাবধারা, শব্দ চয়ন ও তথ্য সংগ্রহ করিয়াছি যাহা গান রচনার ক্ষেত্রে সকলকেই অনুশীলন করতে হয়।’