ছবির আড়ালে ইতিহাস

প্রবীর বিকাশ সরকারঃ ১৯৯১-৯২ সালের কথা।
শিক্ষা সমাপ্ত করে জাপানি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি নানা চেষ্টা-তদবির করার মধ্য দিয়ে। সেই সময় বিদেশিদের জন্য রক্ষণশীল জাপানি প্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন চাকরি পাওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন। চাকরিজীবনও এত ব্যস্তময় যে মরারও সময় ছিল না। দীর্ঘসময় চাকরি, ছুটিছাটা অত্যন্ত সীমিত। তাই বলে বাঁধনহারা বাঙালিকে কি দমিয়ে রাখা সম্ভব?

১৯৯০ এর শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করেছি কতিপয় প্রবাসী বন্ধুদেরকে নিয়ে। তার জন্য প্রচণ্ড খাটাখাটুনি করতে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর সমর্থক খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়েছে, সতর্কতার সঙ্গে গোপনে সভা করতে হয়েছে, কারণ ৩০ হাজার তরুণ বাঙালির মধ্যে ৯৯.৯ শতাংশের বৈধ ভিসা ছিল না। সবাই অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে নানা ভাবে জাপানে প্রবেশ করেছে। ধরপাকড় চলছে সমানে। মামলা হচ্ছে, জেলে ঢোকাচ্ছে, আবার দেশেও ফেরৎ পাঠাচ্ছে। তাদের জন্য দেনদরবার করতে হচ্ছে পুলিশের সঙ্গে, দূতাবাসের সঙ্গে। এশিয়ার হতদরিদ্র এবং সামরিক শাসনে পর্যুদস্ত বাংলাদেশের কোনো প্রকার মূল্যই নেই জাপানি সমাজে তখন!

কী করে থাকবে? এশিয়ার মালয়েশিয়া, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, চীন, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ জাপানের সাহায্য-সহযোগিতায় দমামদ উপরের দিকে উঠে দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে লড়ালড়ি করছে অহেতুক রাজনৈতিক ভেদাভেদ নিয়ে! জাপানের সাহায্য-সহযোগিতা আর বিনিয়োগ নিয়ে চলছে হরির লুট আর দুর্নীতি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দাঙ্গাহাঙ্গামা, রক্তঝরা আন্দোলন, আর সেইসঙ্গে বন্যা-মহামারী ছিল নিত্যদিনের ঘটনা যা জাপানের গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচারিত হত। লজ্জায় রাগে, দুঃখে, মর্মবেদনায় মাথা নিচু করে চলাচল করতে হত আমাদেরকে।

১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে ঘটনাক্রমে যখন জানতে পেলাম জাপানের সঙ্গে বাংলা অঞ্চল ও বাঙালির অনেক পুরনো সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান এবং ১৯৭৩ সালে সেই সম্পর্ক ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপান ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর ভক্তরা এখনো অনেকেই জীবিত আছেন কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তখন মাথার মধ্যে নড়েচড়ে উঠল বাঙালি জাতিসত্তা। মোদ্দাকথা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তাহলে তো জাপানিদের মাধ্যমে আমরা এই দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের আন্দোলন করতে পারি! কেন বাংলাদেশের এই করুণ অবস্থা এর জন্য কারা দায়ী সেই ব্যাখ্যা ও ইতিহাস জাপানিদের কাছে তুলে ধরতে পারি! চলমান জাপান-বাংলা সম্পর্ককে জোরদার করতে পারি! জাপানে তা সম্ভব আমার জাপানি স্ত্রীও বলল।

যেই ভাবা সেই কাজ। তখন বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব ছিলেন মিজারুল কায়েস ভাই। তাঁর সঙ্গে একদিন সস্ত্রীক আলাপ করলাম এই বিষয়ে, তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন যদিও রাজনৈতিক বিষয় এবং বাংলাদেশের বর্তমান শাসক জেনারেল এরশাদ। সমস্যা হতেও পারে। কিন্তু আপনি যখন জাপানে বিয়ে করে স্থায়ী হয়েছেন এবং জাপানের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের সরকার, সুতরাং ঝামেলা করে পারবে না। এগিয়ে যান।

কায়েস ভাই ছিলেন পরম রবীন্দ্রভক্ত এবং বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। তাঁর মতো সরকারি কর্মকর্তার আশ্বাস পেয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি জাপানের কার্যকরী পরিষদের কর্মী পদ থেকে পদত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠনে নেমে পড়লাম।

বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠনের আগে থেকেই একটি তথ্যভিত্তিক কাগজ প্রকাশের পরিকল্পনা এগিয়ে চলছিল। এবার সময় এসে গেল। বঙ্গবন্ধু পরিষদকে সমর্থন জোগাতে, এগিয়ে নিতে পরিকল্পিত কাগজটি ভূমিকা রাখবে মনে হল। বস্ততু, তাই হয়েছিল পরবর্তী ১২টি বছর।

কী যে তুমুল ব্যস্ততা গেছে ধুন্ধুমার সব কর্মকাণ্ড নিয়ে আমার, যারা দেখেছেন সহকর্মী হিসেবে তারাই বলতে পারবেন! বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রথম সম্মেলন হবে, তার জন্য পোস্টার করা, প্রচারপত্র তৈরি করা, চাঁদার রশিদ তৈরি করা, স্মরণিকা তৈরি করা সবই আমাকে করতে হয়েছিল, কারণ এখানে প্রেস নেই, বাংলা ভাষার মুদ্রণ বলতে কোনো সুযোগ-সুবিধাই নেই! কাগজ প্রকাশ করব বলে অ্যাপল কম্পিউটার্স এর পুরো সেট নগদ টাকায় কিনেছিলাম বলে রক্ষা হয়েছিল। বাংলা একটি সফট জোগাড় করে দিয়েছিলেন শিবলী আজম ভাই। কোনোদিন টাইপ করিনি, শিখতে হয়েছিল।

১৯৯১ সালের মার্চ মাসে প্রথম সংখ্যা “মানচিত্র” ট্যাবলয়েড প্রকাশিত হল। দ্বিতীয় সংখ্যার কাজ চলছে, চলছে বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রথম সম্মেলনের প্রস্তুতি সমানতালে। এদিকে ছুটির দিন কোনো কোনো রোববারেও কোম্পানিতে যেতে হচ্ছে কাজের চাপের কারণে। ব্যস্ততা কাকে বলে! ঘুম-টুম সব হারাম হয়ে গেছে। কাজ আর কাজ!

পরের বছর ১৯৯২ সালে আমার মেয়ে টিনার জন্ম হল। ছোট্ট সংসার আলোকিত হয়ে গেল! তাকেও তো সময় দিতে হয়! আদর করতে হয়! আত্মজার শুভাগমন জীবনের সবচেয়ে স্বর্গীয় আনন্দের সময়। মিস করতে চাই না! তাই কোলে নিয়েই কাজ করতে হত প্রায়শ।

আরও ব্যস্ততা বাড়ল ক্রমে ক্রমে। চাকরি, সংগঠন, সংসার করে মাসিক একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করা যে কী একটি মহাযুদ্ধ তা ভুক্তভোগী ছাড়া অনুধাবন সম্ভব নয়। এরপর আরও একাধিক সংগঠন গঠনেও জড়িয়ে গেলাম।

এইভাবে একটানা ব্যস্ততা গেল ২০০২ সাল পর্যন্ত, যে বছর “মানচিত্র” বন্ধ করে দিলাম। বঙ্গবন্ধু পরিষদ ছেড়ে দিলাম, যেভাবে গড়তে চেয়েছিলাম তা দলাদলির কারণে করতে পারিনি, ছেড়েই দিলাম। তবে কোনো উদ্যোগই আমার ব্যর্থ হয়নি। কাজে লেগেছে। আজ এই পর্যন্ত যে আসতে পেরেছি তার জন্য তারুণ্যের লক্ষ্যস্থির স্বপ্ন ও কর্মকাণ্ডই ছিল সঠিক পথ। কাজেই তারুণ্যই ভবিষ্যতের পথ চিহ্নিত করে দেয়।

সুত্রঃ প্রবীর কুমার বিশ্বাস এর ফেইসবুক টাইমলাইন থেকে