তিন মামলায় ফাঁসির দণ্ড, সেই জিয়া এখনও অধরা

একটি-দুটি নয়, তিনটি মামলায় ফাঁসির রায় হয়েছে তার। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) কলাবাগানে আলোচিত জুলহাজ-তনয় হত্যা মামলার রায়েও তাকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন আদালত। আরও অন্তত তিনটি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে (চার্জশিট) নাম রয়েছে তার। কিন্তু তার কোনও হদিস পাচ্ছে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আলোচিত এই ব্যক্তি হলো সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সামরিক কমান্ডার সে। প্রায় এক দশক ধরে আত্মগোপনে থেকে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে আসছে এই জিয়া।

তার বিষয়ে জানতে চাইলে জঙ্গি প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিট ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা তাকে গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ সিটিটিসির উপ-কমিশনার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘জিয়া এখন আমাদের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল। তাকে গ্রেফতারের জন্য যত ধরনের পদ্ধতি রয়েছে, সব পদ্ধতিই প্রয়োগ করে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর ২০১১ সালের ডিসেম্বরে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন থেকেই সে পলাতক রয়েছে। প্রথম দিকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কথা বলা হলেও পরবর্তীতে সে জসিম উদ্দিন রাহমানীর মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম নামে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। পরে সরকার আনসার আল ইসলামকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী এই সংগঠনটির বেশিরভাগ সদস্যই উচ্চ শিক্ষিত এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষভাবে দক্ষ। জিয়া এই সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকে সামরিক শাখার দায়িত্ব পালন করে আসছে। ছাত্র ও কর্মজীবনে মেধাবী জিয়া তার সকল মেধা কাজে লাগিয়ে আনসার আল ইসলামকে সুসংগঠিত করেছে। ২০১৩ সাল থেকে আনসার আল ইসলাম ‘টার্গেটেড কিলিং’ শুরু করে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে লেখক-প্রকাশক ও ব্লগার হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনায় জিয়ার সম্পৃক্ততা ছিল। একারণে অন্তত ছয়টি মামলায় তাকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ব্লগার ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড, প্রকাশক দীপন হত্যাকাণ্ড, সমকামী অধিকারকর্মী ও ইউএসএইডের সাবেক কর্মী জুলজাহ-তনয় হত্যাকাণ্ড, প্রকাশক টুটুলকে হত্যাচেষ্টা মামলা, ব্লগার নিলাদ্রী নিলয়, নাজিম উদ্দিন সামাদ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে অন্যতম আসামি হিসেবে জিয়ার নাম রয়েছে। এর মধ্যে অভিজিৎ রায়, দীপন ও জুলহাজ-তনয় হত্যা মামলার রায়ে আদালত তাকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জিয়াকে ধরতে ২০১৬ সালের ২ আগস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এরপর প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও জিয়ার হদিস পায়নি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও ইউনিট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা আনসার আল ইসলামের সদস্যদের গ্রেফতারের পর জিয়ার বিষয়ে কিছু তথ্য পেয়েছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। কিন্তু তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা যায়নি।

সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ তারা জিয়ার অবস্থান পেয়েছিলেন চট্টগ্রামে। এমনকি পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্ত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশেও তার যাতায়াতের কিছু তথ্য ছিল। কিন্তু তার অবস্থান শনাক্ত করা যায়নি।

সিটিটিসির ওই কর্মকর্তা বলেন, জিয়া তার সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও সব ধরনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় বিশ্লেষণ করে যোগাযোগ রক্ষা করে। এছাড়া যোগাযোগের সময় বিশেষ কোড ব্যবহার করে। এজন্য আনসার আল ইসলামের কেউ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলেও সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি টের পেয়ে যায় জিয়া। এ কারণে আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করে চলাফেরা করে সে।

র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘জিয়াকে ধরতে আমরা নিয়মিত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তার সম্পর্কে যখন যে ধরনের গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা আপডেট করে তার অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চলছে। তথ্য-প্রযুক্তি ছাড়াও ম্যানুয়াল সোর্স ব্যবহার করেও তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’