পুরুষদের ভুলিয়ে নিয়ে যায় এই পেত্নি, তার পরে যা ঘটে তা সাংঘাতিক

শান্তনু চক্রবর্তী : কোনও জলার ধারের পেত্নী, শ্যাওড়া গাছের শাকচুন্নি বা পুরানা হাভেলির চুড়েইল-এর সঙ্গে তাঁর তুলনাই চলে না।

‘স্ত্রী’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: ট্রেলার থেকে

বছরের চারটে দিন ওই আধাগ্রাম-আধা গঞ্জ শহরের বাসিন্দারা হেব্বি টেনশনে থাকেন। চারটে ‘দিন’ না বলে রাত বলাই ভাল। কারণ, দিনের বেলায় তো আর ‘তেনারা’ বেরোন না। তবে ‘তেনারা’ না বলে ‘তিনি’ বলাটাই ঠিক। কেন না এ শহরে আর কোনও ভূত-প্রেত-দত্যি-দানোফানোর গপ্পো নেই। মামদো-বেহ্মদত্যিফত্যিরাও নিশ্চয়ই এদিক পানে ঘেঁষতে ভয় পায়। কারণ, আমার ‘তিনি’ আছেন। ‘তিনি’ একাই এক হাজার। এবং তিনি পুরুষ নন-‘স্ত্রী’। গোটা চান্দেরি শহরও তাকে ‘স্ত্রী’ নামেই জানে। ক্লাইম্যাক্সে ছবির নায়কের সঙ্গে যখন তেনার ‘অফিসিয়াল’ দেখাশোনাটা হয়, সেও কাঁপাগলায় রীতিমত শ্রদ্ধাভক্তি সহকারে ‘স্ত্রী-জি’ বলেই ডাকছিল— যেমন ইন্দিরাজি, সুষমাজি, মমতাজি! এই ‘স্ত্রী’, ‘স্ত্রী-জি’ তেনাদের দুনিয়ায় যাকে বলে ‘স্পেশাল ওয়ান’! কোনও জলার ধারের পেত্নী, শ্যাওড়া গাছের শাকচুন্নি বা পুরানা হাভেলির চুড়েইল-এর সঙ্গে তাঁর তুলনাই চলে না।

তাঁর অ্যাজেন্ডা, মোডাস অপারেন্ডি— সবটাই আলাদা। আমাদের চেনাজানা বইয়ে পড়া পেত্নি-ফেত্নিরা সাধারণত কচি দুব্বোঘাসের মতে শ্যামলারঙা, ডবকা গতর, টানা টানা আঁখোওয়ালি মিষ্টি-পানা মুখের গাঁয়ের বধূদের ঘাড়ে চাপতো। তার পর গতকাল সাঁঝবেলা পর্যন্ত একগলা ঘোমটা টানা, জড়োসড়ো লাজুক বধূটি রাতারাতি এলোচুলে, আলুথালু কাপড়ে উঠোনময় দাপাতো-ঝাঁপাতো ভাঙা-খোনা গলায় মেঠো-খিস্তির বন্যায় বাড়ির এবং গ্রাম-সম্পর্কের যত শ্বশুর-ভাসুর সব্বার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করে দিত— দেখেশুনে গাঁ-সুদ্ধ আম-পাবলিকের চক্ষু চড়কগাছ। প্যাট্রিয়ার্ক দা’ঠাকুর বা ভিলেজ-বস্‌দের কপালে ভাঁজ। পেত্নির অ্যাকশন প্ল্যান হিসেবে আমরা এসবই দেখেশুনে এসেছি। অবশ্য এই লড়াইয়ে ভুতনিটি শেষ পর্যন্ত কখনই জেতে না। কারণ মেয়ে বা বউটির বাড়ির লোক, গাঁয়ের লোক, সবাই মিলে শেষ পর্যন্ত ওঝা-টোঝা ডেকে আনে। সেই লোকটি আবার নানারকম মন্ত্র-ফন্ত্র পড়ে, লঙ্কাপোড়া ধোঁয়া উড়িয়ে মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে, খেজুরগাছের ছড়ি, নিদেনপক্ষে ঝাঁটা দিয়ে বেধড়ক কেলিয়ে বা আরও কিছু স্যাডিস্ট তড়িকা-কসরৎ অ্যাপ্লাই করে পেত্নিটিকে তাড়িয়ে ছাড়ে। ভুতনির উসকানিতে মেয়েটি যেভাবে পিতৃতন্ত্রের আখাম্বা দেরাজে ঝাঁক মেরে মেরে পুরনো সব পাপের কঙ্কাল হদিশ করছিল, সেসব বেয়াড়াপনা বন্ধ হয়। পরিবার ও সমাজের পিতাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে।

‘স্ত্রী’ ছবিতে শ্রদ্ধা কপূর ও রাজকুমার রাও, ছবি: ট্রেলার থেকে

এ তো গেল ভুতের থুড়ি পেত্নির বইয়ে পড়া গপ্পো। কিন্তু গত সাড়ে তিন দশকে রামজে ব্রাদার্স ব্র্যান্ড থেকে মহেশ-মুকেশ ভাট ছাপ্পা হয়ে রামগোপাল বর্মার ‘ফ্যাক্টরি’সে নিকলে হুয়ে যত ‘হরর’-মাল বেরলো, সব ভূতেরই এক রা— কোনও রকমে নরম-সরম-মোলায়েম-চিকন মেয়েলি একটা ঘাড় খুঁজেই ঝড়াকসে তাতে চেপে বসা। ভাট-ক্যাম্পের ‘রাজ’ সিরিজই বলুন, কিংবা রামগোপালের ‘রাত’ বা ‘ভূত’-ই দেখুন— জঙ্গলের ধারে ভূত-বাংলোই হোক অথবা মেট্রো শহরের বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট-ই হোক, ভুতূড়ে কর্মসূচি সেই একই থেকে যায়। আর একটা বলিউডি হরর-ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘রাগিনী এম.এম.এস’-এ তো আমরা এক ভয়ানক পিউরিটান, নীতি-পুলিশ গোছের মরাঠি শাকচুন্নির দেখা পাই, যিনি ‘শাদি কি পহলে’ হানিমুন মানাতে আসা যুবক-যুবতীদের তন্ করতেন।তবে তিনি মেয়েদের ঘাড়ে ফাড়ে চাপতেন না। বরং বয়ফ্রেন্ড সুদ্ধ রিসর্টে ফুর্তি করতে আসা মেয়েদের ঘাড় ধরে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখতেন।

চান্দেরির ‘স্ত্রী’ এদের কারোর মতো নন। তিনি মেয়েদের ‘টাচ্’ করেন না। তাঁর টার্গেট শুধুই ছেলেরা। সেদিক থেকে বলিউডি হরর সিনেমার ইতিহাসে স্ত্রী-ই প্রথম ‘ফেমিনিস্ট’ চুড়েইল। এদেশি হরর সিনেমার ‘জেন্ডার-বায়াস’ বা লিঙ্গ-বৈষম্যের অভ্যেসটাকেই তিনি ঘেঁটি ধরে উলটে দিয়েছেন। পর্দায় লোচ্চা-লাফাঙ্গা, ঘোর কামুক ‘পিয়াসি আতমা’ আমরা অনেক দেখেছি। ভাটদের ‘নাইনটিন টোয়েন্টি(1920)’ সিরিজটাই তো ইহজন্মের আধখানা ধর্ষণ পুরো করার ভৌতিক প্রক্রিয়া— যাকে ‘সেক্স-হরর’ বলা যায়। সেখানে ভয় ভয় ব্যাপারটা অনেক কম, শরীরের খেলাধুলোটাই বেশি।। এমনকী, দেহ-ফেহ কিছু নেই-যেন সদ্য ভায়াগ্রা গিলে এসেছে, এমনই দমকা সেক্সি-হাওয়া নায়িকার পোশাক-টোশাক উড়িয়ে হুড়ুমতাল করছে, হলিউড-টোকা হিন্দি সিনেমায় আমরা তেমনটাও দেখেছি।শয্যাসঙ্গী ‘হাওয়ার’ বাড়াবাড়ি আদরে মেয়েটির কাতরানি শীৎকারও শুনেছি।

স্ত্রী-র ‘অপারেশন’ সেখানে অনেক নিখুঁত, পেশাদার। রাস্তা থেকে, এমনকী ঘরের মধ্যে থেকেও, তিনি স্রেফ নির্ভেজাল-নিরাবরণ পুরুষদেহটিকেই তুলে নিয়ে যান। লোকটির প্যান্ট-শার্ট, কুর্তা-পাজামা, গেঞ্জি-লুঙ্গি, মায় ল্যাঙ্গটটুকুও অকুস্থলে পড়ে থাকে স্মৃতিচিহ্নের মতো। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজে বোনের এক সহপাঠীর লেখা ‘পর্ণোপয়ার’-এর দুটো লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে:
“দুর্ভিক্ষ-মহামারী,মহা হাহাকার।
লোক নাই পড়ে আছে ল্যাঙট তাহার॥”
কিন্তু চুড়েইলটি কেন এমন করেন? কারণ, এই শহরের প্যাট্রিয়ার্ক সমাজ বেঁচে থাকতে তাঁর চরম অসম্মান করেছে। তাঁর সঙ্গে তাঁর প্রেমিকের ‘সুহাগ রাত’-টুকুও হতে দেয়নি। মেয়েটি থুড়ি পেত্নিটি তাই শরীর ভর্তি যৌনক্ষিদে নিয়ে শহর ভর্তি পুরুষদের উপরে ঝাঁপায়।

‘স্ত্রী’ ছবির একটি দৃশ্য, ছবি: ট্রেলার থেকে

তবে শহরের এক নম্বর ‘স্ত্রী’-বিশেষজ্ঞ (স্ত্রী-রোগ নয়) ভদ্রলোকটি এ ব্যাপারে পেত্নি-মহোদয়াকে বিশাল সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তাঁর হিসেবে,পেত্নিটি এখানে রেপ করে বেড়ানো পুরুষদের চেয়ে অনেক বিবেকবতী এবং যথেষ্ট ন্যায়পরায়ণা। পুরুষ (বা পুরুষ-ভূতদের) মতো তিনি কোনও জবরদস্তি করেন না। শুধু পিছন থেকে ফিসফিসে মিঠে-সিডাকটিভ গলায় লোকটার নাম ধরে ডাকেন। এক বার, দু’বার, তিন বার। এখন স্ত্রী-জির কাছে শহরবাসীর নামের লিস্টি কীভাবে এল, উনি শহরের আধার-লিঙ্ক ‘হ্যাক’ করেছেন কি না, এসব আমরা বলতে পারব না। তবে কেউ যদি সাড়া দিয়ে পিছন ফেরে তো উনি ধরে নেন, লোকটা রাজি আছে। অমনি তাকে পাকড়ে ধরে শহরের পিছনে ভাঙা-পুরনো দুর্গ-প্রাসাদে নিজের ডেরায় ধাঁ!সেখানে তাঁর গোপন বেডরুমে কী হয়, ছবিতে সেটা অবশ্য দেখানো হয়নি। তবে পেত্নীটি যেমন সুশীল-স্বভাবের সেখানে ধরে নেওয়া যায় ‘উভয়ের সম্মতিক্রমেই সহবাস’ গোছের কিছু একটা ঘটে থাকে।

পেত্নির হাভেলি, ‘স্ত্রী’ ছবির দৃশ্য। ট্রেলার থেকে

‘স্ত্রী’-র ভদ্রতা ও নিয়মকানুন মেনে চলার আরও নমুনা আছে। যেমন বাড়ির দরজায় যদি লেখা থাকে— ‘ও স্ত্রী,কল্ আনা’, তা হলে উনি ফিরে গিয়ে আবার পরের দিন আসেন। সেদিন যদি লেখাটা কোনোরকমে মুছে টুছে যায় তো, ‘স্ত্রী’ অন্দরে ঢুকে ‘চার্জ’ করেন। নইলে সেই শুকনো মুখে, খালি হাতে ডেরায় ফেরা। এখন লিখতে-পড়তে জানা এমন বুঝদার নারীভুতটি তো পুরুষবাদী সমাজের বিরূদ্ধে নিজের ‘জায়েজ’ প্রতিবাদটা রেজিষ্টার করানোর জন্যই নিজের ডেরায় পালটা পুরুষ হারেম বানিয়েছিলেন। এবার তাঁকে খতম করার জন্যেও যেভাবে একটা পুরুষ শরীরেরই ফাঁদ পাতা হয়, নকল ফুলশয্যার লোভ দেখিয়ে তাঁকে ডেরার বাইরে, তাঁর কমফর্ট জোন থেকে দুরে নিয়ে আসা হয়, কমেডি বা স্পুফ হলেও পুরো ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও একটা নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র-ষড়যন্ত্র গন্ধ থাকে।

আর সেই ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’ও! কারণ পুরো ফাঁদটার ‘মাস্টারমাইন্ড’ আর একজন খুব রহস্যময়ী নারী। তিনি যেভাবে খয়েরি বেড়ালের লোম, টিকটিকির ল্যাজ, আরও কয়েকটা উদ্ভুট্টি জিনিস-টিনিস দিয়ে কালা জাদুর বন্দোবস্ত করে,শ হরের সবচেয়ে রোমান্টিক যুবকটির মগজ-ধোলাই পূর্বক তাকে বর সাজিয়ে, স্ত্রীর টোপ বানিয়ে এগিয়ে দেন— তাতে বোঝাই যাচ্ছিল চক্করটা অনেক বড় কিছু। এখানে পাওয়ার-গেম এর কোনও ব্যাপার থাকতে পারে। ‘স্ত্রী’-কে হঠিয়ে, নায়ককে ‘ভিকি পিলিজ’ বলে হাত করে, সে হয়তো চান্দেরির পুরুষ বাজারে একাই রাজ করতে চেয়েছে। সেদিক থেকে এটা হয়তো একটা অন্য মাত্রার ‘সেক্স-ওয়্যার’— পুরুষদেহের দখল নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া! যার একপক্ষে একজন ‘না-মানবী’— অন্যপক্ষের সুন্দরীটিও পুরো মানবী কি না, কোই গ্র্যান্টি নহি!

সেদিক থেকে তো বলতে হয়, আগে ‘পরি’ এবার ‘স্ত্রী’-দিয়ে, হিন্দি হরর সিনেমার ‘মেল গেজ’-এর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার পালা শুরু হয়ে গেল। সেইসঙ্গে টিকটিকির ল্যাজ এর মতোই ,বলিউডের গা থেকে অনেক ট্যাবু-ফ্যাবু খসে পড়ছে। এর আগে ‘ভির দে ওয়েডিং’-এ শুনেছিলাম, হস্তমৈথুনের ডাকনাম ‘আপনা হাত জগন্নাথ’। ‘স্ত্রী’-তে এক বাবা তার জোয়ান ছেলেকে বলছেন, ‘জওয়ানি কা জোশ’ যদি বড়ই উতলপারা হয়ে ওঠে, তবে মেয়েমানুষ ভাড়া না করে বরং “স্বয়ংসেবক বন্”। স্বমেহনকারী=স্বয়ংসেবক? নাগপুরের আসলি সেবকরা একবার শুনতে পেলে ডায়ালগ লেখক অ্যান্ড কোম্পানির গুছিয়ে সেবা করে দেবে! বা ‘শহরি নকশাল’ তকমা মেরে দেবে।