বলিউড সিনেমাঃ প্রেম-ভালোবাসা- বন্ধুত্বের কৃত্রিম চাহিদা

শেখ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ: বলিউড সিনেমান আমাদের মনে কিছু অবাস্তব চাহিদা বা কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে। এই কৃত্রিম চাহিদাকে আমি নাম দিলাম ‘সিনেমাটিক অভাব’।
বলিউড সিনেমার লাভ-রোমান্স দেখে দেখে আমাদের মনে ভালোবাসা, প্রেম নিয়ে কিছু পরাবাস্তবতা, কৃত্রিম চাহিদা বা অভাবের জন্ম হয়।
আমাদের মনে অবচেতনে কিছু অলৌকিক বা পরাবাস্তব চাহিদা বা অভাব দেখা দেয়।
কিছু উদাহরণ দেইঃ
‘কাভি খুশি কাভি গম’ সিনেমায় বা অনেক সিনেমায় দেখা যায়, নায়িকার ওড়না নায়কের জামার বোতামে আটকে যায়। কিংবা নায়কের হাতের ব্রেসলেট আটকে যায় নায়িকার শাড়িতে।
বাস্তবে এমন ঘটনা প্রায় ঘটেই না।
‘জিন্দেগী না মিলেগি দোবারা’ মুভির মতো কয়েক ব্যাচেলর বন্ধু ঘুরতে গিয়ে ভিন দেশে ক্যাটরিনার মতো সুন্দরী মনের মানুষ খুঁজে পায়। ঘুরতে গিয়ে এমন ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
‘গজনী’ মুভির নায়িকা কল্পনা নিজের সবচেয়ে প্রিয় গাড়ি বিক্রি করে দেয় নায়কের মায়ের চিকিৎসা করার জন্য। এমন প্রেমিকা পাওয়ার আকাঙ্খা মনের ভেতর পুষে রেখে ছেলেদের কি খুব বেশি লাভ আছে?
‘জানে তু ইয়া জানে না’ মুভিতে নায়ক জয় তার বান্ধবী অদিতির রাগ ভাঙানোর জন্য অদ্ভুত অদ্ভুত বোকা বোকা কাজ করে। বাস্তব জীবনে কয়টা বন্ধু এমন করে?
‘ওয়েক আপ সিড’ মুভির নায়ক- নায়িকা সিড আর আয়শা একসাথে নাস্তা করে, খাবার খায়, ঘুরতে যায়, শপিংয়ে যায়, এমনকি লন্ড্রিও করে একসাথে।
বাস্তবে সারাদিন সব কাজ একসাথে করাটা কঠিন বৈকি।
‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ মুভির নায়িকা বানি’র মতো প্রেমিকের আসল প্রতিভা খুঁজে বের করে তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করার মতো প্রেমিকা বাস্তবে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
‘জব উই মেট’ সিনেমার নায়ক-নায়িকা গীত ও আদিত্যর মতো কয়টা জুটি একসাথে বৃষ্টিতে নাচে?
‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়, মোহাব্বাতে, স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’ মুভি দেখে ভেবেছিলাম কলেজ-ভার্সিটিতে সারাদিন শুধু আড্ডা-মাস্তি আর খেলাধুলা। অথচ বাস্তব জীবনে কলেজে দম ফেলার সময় পাই নি। ভার্সিটিতে খেলাধুলার চেহারা দেখি নি।
‘আওয়ারাপান’ মুভিতে দেখলাম ইমরান হাশমি নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যের প্রেমকে রক্ষা করে। অথচ বাস্তবে কারো প্রেমকেই কেউ রক্ষা করতে আসে না। উলটা সম্পর্ক ভাঙার মতলবে থাকে সবাই।
‘লাকির’ সিনেমায় দেখি অন্যের প্রেমিকাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করায় সানি দেওল তার আপন ছোট ভাইকে গুলি করে মারে।
বাস্তব জীবনে এমন প্রেম-রক্ষক খুঁজে পাওয়া যায় না।
‘দেবদাস’ শেখায় প্রেমিকার বাড়ির সামনে গিয়ে মরে যেতে। আহা! কয়জন এভাবে মরে?
রুস্তম সিনেমায় অক্ষয় শেখালেন বউ অন্যের কাছে গেলেও তাকে নিয়েই পরে সংসার করতে হয়। বাস্তবে কয়জন তা করে?
অক্ষয় কুমারের ‘দেশি বয়েজ, থ্যাংক ইউ’ সিনেমা শেখায় স্বামী যেখানে যেখানে একাউন্ট খুলে বেড়াক না কেনো স্ত্রীরা সেসব মেনে নিয়ে আবার সংসার করবে।
বাস্তবে স্বামীর এহেন পরকীয়া কয়টা স্ত্রী মেনে নেয়?
আমিরের ‘থ্রি ইডিয়ডস’ মুভিতে শিখলাম যার যা পড়তে ইচ্ছা করে, হতে ইচ্ছা করে তার তাই পড়া উচিত, তাই হওয়া উচিত। বাস্তবে কী তা হয়?
‘এক ভিলেন’ মুভিতে শিখলাম নায়িকার বাড়ির সামনে সারারাত বসে থাকতে, শুয়ে থাকতে।
বাস্তবে কয়জন তা করে কিংবা কয়জনের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়?
বলিউড মুভি দেখে দেখে আমাদের প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রীর মনের মধ্যে পরাবাস্তব একধরনের চাহিদা তৈরি হয়।
প্রেমিক হবে এরকম ওরকম, প্রেমিকা হবে এরকম-ওরকম, স্বামী এই করবে ঐ করবে, স্ত্রী এই করবে ঐ করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সিনেমাঘটিত অভাব বা সিনেমাটিক অভাব আমাদের মনে দানা বাঁধে। শাহরুখের মতন প্রেমিক না পেয়ে আমাদের প্রেমিকাদের মনে অভাবের জন্ম হয়। কিংবা অক্ষয়ের মতন আকাম-কুকাম করার পরেও স্বামীরা চায় তাদের স্ত্রীরা তাদেরকে মেনে নিয়ে হাসিমুখে সংসার করবে।
প্রেমিক- প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রীর এই সিনেমাঘটিত অভাব তাদের মনে হীনমন্যতার জন্ম দেয়।
এই অভাব বোধ ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তবু আমরা সিনেমাটিক পরাবাস্তব দুনিয়ায় ঘুরতে পছন্দ করি। স্বপ্ন দেখি গজনীর কল্পনার মতো প্রেমিকার, কিংবা দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে এর রাহুলের মতন প্রেমিকের।