লাখ টাকার কোরবানিতেও মাংস পায়নি মিনু বেগম

সাকিব মোহাম্মদ আল হাসান : ঈদে আগের দিনে গুছিয়ে রেখেছিলো কয়েকটা পিয়াজ রসুন, কাগজে মুড়িয়ে তুলে রেখেছিলো একটু জিরে মসলা।
সারারাত ধরে অপেক্ষা- সকালে গোশত টুকাতে যাবে।

সকালে ঘরের দরজা টেনে দিয়ে দুই ছেলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মিনু বেগম। বড় ছেলেটার বয়স বছর ছয়েক, মায়ের শাড়ি ধরে পিছন পিছন হাঁটছে, তিন বছরের ছোট ছেলেটা মিনুর কোলে, ঘুম জড়ানো চোখে কাধে মাথা দিয়ে আছে।

তরফদার সাহেব এবার বড় গরু কোরবানি দিচ্ছে। বাড়ির বাহিরে বেঁধে রাখা। গরুর চারপাশ ঘিরে বসে আছে অভাবী লোকজন। মিনু চিন্তা করে -এখানে বসে না থেকে আরো কয়েক বাড়ি ঘুরে, এখান থেকে গোশত নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ছেলেদের সাথে নিয়ে এগিয়ে যায় মিনু…

কিছুদূর যেতেই প্রাচীর ঘেরা বড় বাড়ির সামনে জটলা দেখে মিনু দাঁড়িয়ে যায়। ভিড় ঠেলে যারা বের হয়ে আসছে তাদের হাতে পলিথিনের পুঁটলি ভরা গোশত দেখে মিনুর অভাবী চোখ চকচক করে ওঠে। বুকের সাথে ছোট ছেলেটা জড়িয়ে – বড় ছেলেটার হাত নিজের হাতে শক্তকরে ধরে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে যায় মিনু বেগম।

পা রাখার জায়গা নেই। অনেক সময় পর ধাক্কাধাক্কিতে গেটের কাছাকাছি চলে আসে মিনু। সামনের পাঁচ ছয়জনের পর তার হাতেও আসবে কোরবানির কাঙ্ক্ষিত গোশত। এমন সময় হোট্টগোল শুরু হয়ে যায়। পিছন থেকে জোরে চাপদিলে কোলের ছেলে নিয়ে ইটের দেয়ালে ধাক্কা খায়। ছোট ছেলেটা চিৎকার করে ওঠে। ডান হাতের মুঠি থেকে বড় ছেলের হাত ফসকে যায়। এতো মানুষের মধ্যে থেকেও মিনু নিজেকে নিদারুণ অসহায় বোধ করে। নিজেও কেঁদে ফেলে।

মিনুর শরীরে আর শক্তি নেই, এতোগুলা মানুষকে ডিঙ্গিয়ে গোশত নেয়া তার পক্ষে সম্ভব না। কোনরকম ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে আসে। বড় ছেলেটাকে খুঁজতে থাকে মিনু। দেখতে পায় বড় ছেলে মাটিতে বসে কাঁদছে, মা’কে দেখে দৌঁড়ে আসে।
জিজ্ঞেস করে- মা তুমার হাতে গোছতো কই? বাড়ি যেয়ে কি নান্না করবানে মা?
– মিনু ছেলের কথায় কোন উত্তর করে না, কাপুড়ের ময়লা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নেয়। মায়ের চোখ দেখে বড় ছেলে বুঝে যায়।
অভাবের সংসারের শিশুরা অল্পতেই সাবালক হয়ে ওঠে।
বলে- মা চলো একেন তে গোছতো নিতে হবে না।

দুই ছেলে নিয়ে ফিরে আসে মিনু বেগম। তরফদার বাড়ির যেখানে বড় গরুটা বাঁধা ছিলো সেখানে কেউ নেই। অনেক আগেই কোরবানি শেষ করে চলে গেছে। পাশে কয়েকটা কুকুর হাড় চিবাচ্ছে। ছোপ ছোপ গরুর রক্ত পড়ে আছে। বড়ছেলেটা রক্তের দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে আছে। মা’কে কোন কথা না বলে সামনে হাঁটতে থাকে।
ফেরার পথে মিনুর পা ভারি হয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবে এতো কষ্টের জিরে মসলা কোরবানির ঈদেও ব্যবহার হলো না।