জন্ম থেকে কেন জ্বলছে বাংলাদেশ

মোমিন মেহেদী: নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকার জুস কারখানার ভেতরে দীর্ঘ ২৮ ঘন্টা ধরে আগুন জ্বলেছে। আগুন লাগার ২৮ ঘণ্টা পার হলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ৫৫ জনের লাশ উদ্ধার করেছিলো। আর হাসপাতালে শত শত মানুষ আহত হয়ে পরে আছে। এটা সত্য যে, কর্তৃপক্ষের কারণে নির্মম মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। যেমনটি হয়েছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। সেখানকার কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের দায় এড়ানোরা সুযোগ নেই কর্তৃপক্ষের। ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এক্ষেত্রে মানা হয়নি শিল্পনীতি অনুযায়ী বিল্ডিং কোড। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, ভবনে ছিল না যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জরুরি নির্গমনের পথ ছিল বন্ধ। বিভিন্ন ফ্লোরের কেচিগেটগুলো ছিল বন্ধ। ভবনটি ছিল দাহ্য পদার্থে ঠাসা। এটি ছিল উৎপাদনমুখী কারখানা। নিয়ম বহির্ভূতভাবে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছিল গোডাউন।

আগুন লাগার পরও শ্রমিকদেরকে ভেতরে আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ভবনটি বিল্ডিং কোড না মেনে করা হয়েছে। অগ্নিকান্ডের সময় ৬ তলা ভবনটির মধ্যে ৪ তলার শ্রমিকরা কেউ বের হতে পারেননি। সিকিউরিটি ইনচার্জ ৪ তলার কেচিগেটটি বন্ধ করে রাখায় কোন শ্রমিকই বের হতে পারেনি। ভবনের প ম তলায় ছিল কেমিক্যালের গোডাউন। আর কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। গোডাউনের কারণে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। অগ্নিকান্ডের সময় বহির্গমন পথ না থাকায় কারখানার ভিতরে অনেক লোক আটকা পড়ে। তাদের ভিতর থেকে বের করতে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেয়নি কারখানা কর্তৃপক্ষ। সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড এন্ড বেভারেজের ছয়তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলার একটি ফ্লোরে কার্টুন এবং পলিথিন তৈরির কাজ চলত। সেখান থেকেই হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ভবনে প্রচুর পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য থাকায় আগুনের লেলিহান শিখা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকান্ডে ভস্ম হয়ে যায় ভবনের সবকিছু।

এভাবে কিছুদিন পরপরই আগুনের লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়ে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ। পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন হাজার হাজার মানুষ। গত ১৫ বছরে অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৩১৭ জনের। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৩৭৪ জন। এই সকল ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-দপ্তর-অধিপ্তর ও কর্তাদের দুর্নীতি। তারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে একের পর এক কলকারখানা অনুমোদন দিচ্ছে, অথচ সেই সব কলকারখানার অধিকাংশই মানে না নিয়ম-কানুন। নিয়ম না মানা কল-কারখানাগুলোর অধিকাংশেরই মালিক ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় নেতাকর্মীরা। দুর্নীতিগ্রস্থ কর্তাদের দুর্নীতিময় অনুমোদন এবং অগ্নিকান্ড নির্বাপণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা তথা আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে এত এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে আমি মনে করি। অবশ্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি মানুষের সচেতনতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক। ২০০৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া গেছে হতাহতের এ হিসাব। এরমধ্যে ২০২০ সালে অগ্নিদুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৫৪ জন। আহত হয়েছেন ৩৮৬ জন। তার আগের বছর ২০১৯ সালে নিহত হয়েছেন ১৮৫ জন এবং আহত হয়েছেন ৫৭১ জন। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর দেশের ইতিহাসে কারখানায় সবচেয়ে মারাত্মক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের ওই অগ্নিকান্ডে ১১৭ জন পোশাক শ্রমিক নিহত ও ২০০ জনের অধিক আহত হন। সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ১০১ জন শ্রমিক ও আগুন থেকে রেহাই পেতে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় আরও ১০ জনের।

একথা সত্য যে, জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন না হলেও তথাকথিত উন্নয়নের রোল মডেল বানানোর নাটকিয়তায় অগ্রসর হচ্ছে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ। যে কারণে নির্মম সত্য হলো এই যে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও অগ্নিকান্ড নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকলেও তা যথোপযুক্ত হয়নি। আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে বড় অগ্নিকান্ডগুলো অল্প সময়ে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ফায়ার সার্ভিসের কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে হবে। এ সংস্থাকে আরও গতিশীল করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন করতে হবে। তাহলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও বাড়বে। বাসা-বাড়ির অগ্নিকান্ডের জন্য বেশি দায়ী অসচেতনতা। অনেক ক্ষেত্রে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও প্রশিক্ষণের অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর কল-কারখানাগুলোতে বিল্ডিং কোড না মানার ফলে অগ্নিকান্ড বাড়ছে। এসব দিক খেয়াল রাখলেই অগ্নিকান্ডে নিহতের সংখ্যা কমে আসবে। অবশ্য বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে একের পর এক করোনা পরিস্থিতিতেও অপরাধ-দুর্নীতির রামরাজত্ব তৈরির চেষ্টা অব্যহত রয়েছে। যেই অপরাধী-দুর্নীতিবাজদের কলকারখানাগুলোতে বেতন নিয়মিত দেয়া হয়না; প্রতিবাদ করলেই কারখানার গেট আটকে রাখা হয়। আর সেই আটকে রাখা গেটের ভেতরে-কারখানায় আগুন লেগে অসংখ্য মানুষ মৃত্যু বরণ করে, আহত হয় হাজার হাজার মানুষ। ফায়ার সার্ভিসের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী- ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৪৮৫ জন অগ্নিদুর্ঘটনায় নিহত এবং ৩ হাজার ৮৬৮ জন আহত হয়েছেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ১২৮ জন নিহত ও ৫ হাজার ৮১৭ জন আহত হয়েছেন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৬৫ জন নিহত এবং ১ হাজার ৭৩২ জন আহত হয়েছেন। এসবের বাইরে এ সময়ে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে প্রাণ হারান আরও ২০৪ জন এবং আহত হন ১ হাজার ৭০৬ জন।

আগুন নিভে যাবে বলে চার তলায় তালা দিয়ে ৭০ থেকে ৮০ জন শ্রমিককে ভেতরে বসিয়ে রাখা হয়। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অন্যান্য তলার শ্রমিকরা অনেকে বের হতে পারলেও চারতলার শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। আগুনের খবর পেয়ে পাঁচ তলা থেকে কেউ কেউ লাফিয়ে পড়েন। একথাও সত্য যে, মালিকপক্ষের দোষেই কারখানায় আগুন লাগে। এছাড়া মালিকপক্ষ শ্রমিকদের চারতলায় আটকে রেখে হত্যা করে। আমরা এ নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাই। কারখানাটিতে দুটি গেট থাকলেও একটি গেট কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রাখে। কোনো দুর্ঘটনা হলে শ্রমিকরা দ্রুতগতিতে বের হতে গেলেও শ্রমিকদের পদদলিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। হাসেম ফুড কারখানাটি অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলতো।

এ কারখানায় অগ্নি নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া কারখানাটিতে বেশিরভাগই শিশু শ্রমিক কাজ করতো। এছাড়া কারখানাটি খাদ্য পণ্যে অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করতো। অতিরিক্ত কেমিক্যালের কারণে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের এতো দেরি হয়। এছাড়া কারখানাটির ভবন থেকে বের হতে শ্রমিকদের জন্য কোন ইমারজেন্সি এক্সিটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এরপরও এই কারখানাটি অনুমোদন পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর থেকে। কারা দিয়েছে এই অনুমোদন? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে সেই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সকলকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে করি। তা না করা হলে অতিতের মত এই নির্মম ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখে অন্য কোন কারখানার মালিক অথবা অন্য কোন কর্তারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে গড়বে ভয়াবহ মৃত্যুপুরী। যা আমাদের কাম্য নয়; তাই চাই প্রকৃত তদন্ত; চাই সংশ্লিষ্ট সকলের ফাঁসি; সেই ব্যক্তিরা হোক ফায়ার সার্ভিস বা অন্য যে কোন দপ্তর-অধিপ্তর-পরিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের রাঘববোয়াল। পাশাপাশি সরকারী দলের নেতাকর্মীদেরকে দিতে হবে সততার শিক্ষা-আমলাদেরও চাই দুর্নীতি বিরোধী দীক্ষা। কেননা, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে কেবল লোভ আর মোহের রাস্তায় অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেছে অধিকাংশ মানুষ। সেই কারণেই একের পর এক অন্যায়-অপরাধ-দুর্নীতি আর সংকট-সমস্যার দেশে পরিনত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের পাশাপাশি ষড়যন্ত্রকারী একটি মহল লোভে-লাম্পট্যে দেশকে কষ্টের কারাগারে পরিনত করেছে।

ছাত্র-যুব-জনতার অধিকার হরণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে আরেকটি মহল; যারা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিনত হচ্ছে। এরই মধ্যে একের পর এক ঘটে চলছে মৃত্যুর মহা উৎসব। সেই উৎসবের ধারাবাহিকতায় আমরা রানাপ্লাজা ট্রাজেডি, তাজরীন ট্রাজেডিসহ অসংখ্য ঘটনার কথা জেনেছি। এসব ঘটনায় আমরা হাজার হাজার মানুষকে প্রাণ হারাতেও দেখেছি। অবাক-কষ্ট ও বেদনার হলেও সত্য যে, জাতি কোন দুর্ঘটনার-ই প্রকৃত তথ্য জানতে পারেনি। হয়নি বিচার এইসব ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদেরও কোন বিচার। সর্বশেষ সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৫৫ শ্রমিকের মৃত্যুতে শোকের মাতম চলছে। স্বজনদের আহাজারিতে কারখানার চার পাশের পরিবেশ ভারি হয়ে আছে। শিশু-কিশোর-কিশোরী, নারী, পুরুষের পোড়া লাশের গন্ধ বাতাসে। এমন মর্মান্তিক মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা, মেনে নিতে পারছি না আমরাও…

মোমিন মেহেদী

লেখক পরিচিতি : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি